শিরোনাম :
সমস্যাগুলো স্থানীয়ভাবে সমাধানের চেষ্টা করলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে ; ড. বদিউল আলম আ’লীগ নেতা কায়সার থেকে জমি কিনে অনেকেই জিম্মি; টাকা চাইলেই হুমকি! মোদির উপহার দেওয়া সেই কালী ঠাকুরের স্বর্ণের মুকুট চুরি আবারও আয়করমুক্ত সুবিধা পেলো গ্রামীণ ব্যাংক ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হতে দেব না: আসিফ মাহমুদ সারাদেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দূর্গোৎসব পালিত হচ্ছে ড.মঈন খান নরসিংদীতে ঘোড়াদিয়া মধ্যপাড়া টিভি কাপ টুর্নামেন্টের ফাইনাল রাজশাহী জেলা পরিষদ প্রশাসকের বিভিন্ন পূজামন্ডপ পরিদর্শন শান্তিতে নোবেলজয়ী সংস্থাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ড. ইউনূস আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনা অব্যাহত রাখবে বাংলাদেশ
শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৫১ অপরাহ্ন

জেল পালানো আসামীর আত্মসমর্পণ, বনে গেলো জঙ্গী; অত:পর গুলিতে মৃত্যূ

মো.শাহ্দাৎ হোসেন রাজু / ৮০ Time View
Update : সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক 

‘আমার জিন্নায় আইছত। কই আমার জিন্না, আমার সামনে আয় বাপ।” বুক ফাটানো আর্তনাদ করতে করতে বিলাপের সুরে কথাগুলো বলে যাচ্ছে ছেলে হারানো এক মা জোসনা বেগম (৫৫)। মায়ের এই আর্তনাদের পুরোবাড়ী জুড়ে কান্নার রোল পড়ে। শুধু পরিবারের সদস্যরাই কাদঁছে এমন নয়; আত্মীয়-স্বজন পাড়া প্রতিবেশি উপস্থিত সবাই। তাদের সমস্বরে কান্নায় চারপাশের বাতাস ভারি হয়ে উঠে ।

গত ৬ আগস্ট গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দীরা বিদ্রোহ করে কারাগার ভেঙ্গে পলায়নের সময় কারারক্ষীদের গুলিতে ৬ জন বন্দী নিহত হয়। তাদের মধ্যে জিন্নাহ (২৮) একজন। আর্তনাদ করা সেই ছেলে হারা মা নিহত জিন্নাহর গর্ভধারিনী। তিনি আবার কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন ‘ নরসিংদী জেলখানাত্তে পলাইন্যা আসামীগো মইধ্যে আমার জিন্নাহও একজন। আমার পোলায় আমারে কইছে মা আমি ইচ্ছা কইরা পলাই নাই।হেইদিন যদি জেলেরতে পলাইয়া না আইতাম তায়ইলে পুইরা মরতে অইতো। আমার পোলা শুক্কুরবার দিন নরসিংদী জেলখানাতে পলাইয়া আইছে আর লোববারে লাইপুরা থানাত গিয়া নিজেই ধরা দিছে। এইবার আমনেরাই কন যেই পোলা জেলেত্তে পলাইয়া আওয়নের দুইদিন পর নিজে গিয়াই ধরা দেয় সে আবার কিয়ের লাইগ্যা পলাইতে যাইব। কন স্যার আমার পোলায কি ল্লাইগ্যা আবার পলাইতে যাইব, কন্না স্যার।’ বলেই আর্তনাদ করা মা জোসনা বেগম প্রতিবেদকের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেন । না ছেলে হারা মায়ের এমন প্রশ্নের জবাব এই প্রতিবেদকের কাছে নেই।

গত ৭ আগস্ট দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনলাইন ভার্সনে “কাশিমপুর কারাগার থেকে ২০৯ বন্দির পলায়ন; গুলিতে জঙ্গিসহ নিহত ৬” এই শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হয়। এতে বলা হয় ৬ আগস্ট (মঙ্গলবার) দুপুরে কারাগার থেকে বন্দি পালানো ঠেকাতে গুলি ছুড়েন কারারক্ষীরা। এতে ৬ জন নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে তিন জঙ্গি ছিল।

প্রকাশিত সংবাদে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার সুব্রত কুমারের (বর্তমানে বরখাস্তকৃত) বরাতে নিহতদের পরিচয়ে নরসিংদীর নলভাটা এলাকার জাকির হোসেনের ছেলে নিহত মো. জিন্নাহ (২৮) হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার মামলার আসামি। অথচ নলবাটার দুটি গ্রুপের দ্বদ্ধের জেরে করা মামলায় চলতি বছরের ৫ জুন তারিখে জিন্নাহসহ এলাকার ৩৫ জন নরসিংদী জজ আদালতে হাজিরা দিয়ে বের হওয়ার সময় সেখান থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় আমিরগঞ্জ ফাঁড়ি পুলিশ ইনচার্জ আমিনুল ইসলাম। পরে তাকে ১৮০ পিচ ইয়াবা টেবলেটসহ মাদক মামলা আটক দেখিয়ে আদালতে প্রেরণ করেন।

সম্প্রতি সরেজমিন নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার আমিরগঞ্জ ইউনিয়নের নলবাটা গ্রামে নিহত জিন্নাহর বাড়ীতে ঢুকতেই নজরে আসে বাড়ী-ঘরের টিন, দরজা জানালা যেগুলো কুপিয়ে ফানা ফানা করে ফেলেছে সন্ত্রাসীরা। বাড়ী তিনটি ঘরই বর্তমানে পরিত্যাক্ত অবস্থায় আছে। শুধু একটি ঘরে থাকে জিন্নাহর পরিবার।

ভিতরে ঢুকতেই এক হৃদয বিদারক দৃশ্যের অবতরণ হয়। দেখা যায়, ছেলে হারা পাগল প্রায় মায়ের আর্তনাদ, দৃষ্টি প্রতিবন্ধি পিতার হাপিত্তাস, বিধাবা স্ত্রী হোসনা বেগমের অন্ত:দহন, মাদরাসা পড়ুয়া ছোট বোন আরজিনার বুক ফাটা কান্না, বিবাহিত বড় বোন পারভিন আক্তারের অঝোর ধারায় অশ্রু । সত্যিই এদের এই কান্না দেখে যে কারোরই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়বেই।

দশ মাসের কন্যা সন্তান সিনহাকে কোলে নিয়ে পাথরের মুর্তির মত ঠাই দাঁড়িয়ে আছে জিন্নাহর স্ত্রী হোসনা। এদিকে তাদের ৪ বছর বয়সী ছেলে আরফাত আপন আনমনে এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছে।

সরেজমিন নলবাটা গ্রাম ঘুরে স্থানীযদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে নলবাটা গ্রামের গোলজার মেম্বার গ্রুপ এবং পার্শ্ববর্তী ভাটি বদরপুর গ্রামের রবি গ্রুপের মধ্যে বালু ব্যবসা কেন্দ্র করে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ চলছিল। গত রমজান মাসের প্রথম দিকে অটো রিক্সা নিয়ে নলবাটা গ্রামের জাকিরের ছেলে জিন্নাহর সাথে কথা কাটাকাটি হয় স্থানীয় যুবলীগ নেতা সবুজ সাথে। এর জেরে আমিরগঞ্জ ইউনিয়ন সেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি (রবি গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ড) সোহেলের নেতৃত্বে ২৫/৩০ জন সন্ত্রাসী দা, ছুরি, টেটা, বল্লম ও আগ্নেয় অস্ত্রসহ জিন্নাহর বাড়ী ঘরে অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় বাড়ীর তিনটি ঘরে ভাঙ্চুরসহ কুপিয়ে সেগুলো বসবাসে অযোগ্য করে তুলে। সন্ত্রাসীরা জিন্নাহর বাবা জাকিরকে দা দিয়ে কুপিয়ে আহত করে। এসময় বৃদ্ধ বাবাকে বাঁচাতে মাদরাসা পড়ুয়া জিন্নাহর ছোট বোন তানজিনা এগিয়ে আসলে তাকেও কুপিয়ে আহত করা হয়।

এঘটনার পর উল্টো জিন্নাহ তার পরিবারের সদস্যসহ গোলজার মেম্বার গ্রুপের বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা দেয় রবি গ্রুপের সবুজ। সেই মামলায় হাজিরা শেষে ফেরার পথে নরসিংদী আদালতের প্রধান গেইটের সামনে থেকে জিন্নাহকে তুলে আনা হয় বলে জানায় সেদিন তার সাথে থাকা ব্যক্তিরা।

জিন্নাহর বড় ভাই মোক্তার হোসেন বলেন, ৫ জুন হাজিরা শেষে নরসিংদী কোর্ট থেকে বের হওয়ার সময় মেইন গেটের সামনে আসলেই আমিরগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আমিনুল জিন্নাহকে গাড়িতে তুলে নিয়ে আসে। পরে ১৮০ পিস ইয়াবা টেবলেটসহ তাকে মাদক মামলায় কোর্টে চালান দেয়।মামলায় উল্লেখ করা হয় জিন্নাহকে ১৮০ পিস ইয়াবাসহ নলবাটা প্রাইমারি স্কুলের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয়। জেল হাজতে থাকার কিছুদিন পর গত ১৯ জুলাই জানতে পারি জিন্নাহ জেল থেকে পালিয়ে এসেছে। জুলাই মাসের ১৯ তারিখ জেলখানা থেকে পালিয়ে আসার পর ২১ তারিখ আমার বাবাকে সাথে নিয়ে সে রায়পুরা থানায় আত্মসমর্পণ করে। পরে আগস্ট মাসের ৬ তারিখ খবর পাই কাশিমপুর কারাগার থেকে পালানোর সময় পুলিশের গুলিতে সে মারা গেছে। আমার একটা প্রশ্ন যে জেল থেকে পালিয়ে আসার পর নিজে পুলিশের কাছে ধরা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে সে আবার কেন জেলখানা থেকে পালাতে যাবে। তবে আমি আমার ভাইয়ের এই মৃত্যুর জন্য আমিরগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আমিনুলকে দায়ী করি। সেদিন যদি তাকে মাদকসহ চালান না দিতো তাহলে আজ সে লাশ হয়ে বাড়িতে আসতো না।

জিন্নাহর চাচা বলেন, রাস্তার পাশে ঘর থাকায় গত রমজান মাসের একদিন সকালে রাস্তায় চিল্লাচিল্লি শুনে জিন্নাহ ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সেখানে গিয়ে জানতে পারে অটোরিকশা নিয়ে তাদের মধ্যে বাক-বিতাণ্ডা হচ্ছে। জিন্নাহ তাদেরকে জিজ্ঞেস করে এতো জোরে জোরে কেন চিৎকার চেঁচামেচি করছে। এতে সবুজের সাথে তার কথা কাটাকাটি হয়। এরপর দিন সকালে সবুজ লোকজন নিয়ে বাড়িতে হামলা চালায়। তারা দা দিয়ে কুপিয়ে সব লণ্ডভণ্ড করে ফেলে। এ সময় তারা আমার ভাই জাকির মিয়া ও ভাতিজি তানজিনাকে কুপিয়ে আহত করে। এই ঘটনায় তারাই উল্টো আমাদের নামে মামলা দেয়। ওই মামলায় হাজিরা দিতে নরসিংদী কোর্টে গেলে সেখান থেকে আমিরগঞ্জের পুলিশ সবার সামনে জিন্নাহকে ধরে নিয়ে আসে। পরের কথা আর কি বলবো।

নলবাটা গ্রামের আ. রউফ বলেন, জিন্নাহ যেদিন পুলিশে ধরা দিতে রায়পুরা থানায় যাচ্ছে সেদিনের সেই মুহূর্তের দৃশ্য আমার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠে । সেদিন আমি গরু নিয়ে এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার কানে ভেসে আসে ‘বাবা তুমি যেও না যেও না’ বলে চিৎকার করছে। পিছনে ফিরে দেখি জিন্নাহর চার বছরের ছেলে তাকে যেতে নিষেধ করছে। আর জিন্নাহ বলছে ‘আমি বাবা যামু আর আমু আহনের সময় তোমার লাইগা মজা লইয়া আমু।’

জিন্নাহর চাচী মাফিয়া বলেন, ‘জিন্নাহ আমার ভাসুরের পুত। সে ড্রেজার মিস্ত্রি ছিল। ওই কাম কইরা সবার খাওন পড়ন ও ছোট দুই বোনের পড়ালেখার খরচ চালাইতো সে। অহন হেয় নাই আমার ভাসুর তারপর যোগ কইরা এই সংসারটা চালাইতাছে জানিনা হেগো ভবিষ্যৎ কেমনে যাইবো।

স্ত্রী হোসনা বলেন, “আমার স্বামীর কি অপরাধ আছিল। কি দোষে তারে জেলে দিল। যার লাইগা আজক্যা সে লাশ হইয়া বাড়ি আইলো। আমি এই ছোট ছোট পোলা পাইনরে কেমনে খাওয়ামু, কেমনে পিন্দামু। আমার এই দুইটা পোলা পাইনের ভবিষ্যৎ কি আর হেরা কারে বাবা বইল্লা ডাকবো।আমি অহন কি করমু আপনারা কি আমারে এবটু কইবেন। আমার স্বামীরে যারা মারছে যারা তার এই মৃত্যূর জন্য দায়ী আমি তাদের বিচার চাই।”

জিন্নাহর বৃদ্ধ বাবা মো. জাকির বলেন, “আমার এই পোলা পুরা সংসারটা চালাইতো । অহন আমরা আমরা কি খাই কি পিন্দি, সেইডা আল্লাহই বালা জানে। আমার একটাই কথা সেদিন যদি আমার পোলারে মিথ্যা মাদক মামলায় মামলায় জেলে না দিত তাহলে আমার জিন্যাস লাশ হইয়া বাড়ি ফিরত না। আমি চোখে দেখি না বাউল যতটুকু দেখি পুতেরে দেখনের লাইগা কাশিমপুর গেছিলাম। জেল গেটের সামনে সারাদিন থাক্যাও পুতের দেয়া পাই নাই। হেরা আমার লগে দেখা করতে দেয় নাই। পরে পুতেরা না দেখ্যাই বাড়ি ফিরা আসি। আমিরগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ি ওই দারোগা টাকা খাইয়া মাদক দিয়া জেলখানায় পাঠাচ্ছে। সে কার কাছে থেকে টাকা খাইয়া আমার পুতেরে ধইরা নিছে আপনারা একটু কষ্ট কইরা হাইরে খুইজা বাইর করেন। আমনেগো কাছে আমার আর কোন চাওয়া পাওয়া নাই। সেদিন মাদক দিয়া মিথ্যা মামলা হেরে জেলে না পাঠাইতো তাই তার কাশিমপুরও যাইতে অয়না। আর লাশ অইয়াও বাড়ী আইত না। আমি এর সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আমার জিন্নাহর হত্যার বিচার চাই। আমনে গো মাধ্যমে সরকারে কাছে আমি এই দাবি জানাই।”

এব্যাপরে আমিরগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আমিনুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করলে কোর্ট গেইটের সামনে থেকে গ্রেফতারের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, মাদকসহ জিন্নাহকে নলবাটা এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে।।

এদিকে মাদক মামলায় গ্রেফতার হ্ওয়া জিন্নাহ কিভাবে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা মামলার আসামি হলেন বিষয়টি জানতে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের বরখাস্তকৃত জেল সুপার সুব্রত কুমারের যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

শিপ্র/শাহোরা/


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!