নিজস্ব প্রতিবেদক
জুলাই সনদ বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে প্রতিবাদকে যে দেশের রাজনীতি করছি আবারও ব্লাড হতে পারে জেরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবারও ঘোলাটে হতে পারে। কারণ এই সনদ বাস্তবায়নে ‘সংবিধান আদেশ’ ও গণভোটের ব্যাপারে অনড় অবস্থানে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি দল। অন্যদিকে বিএনপি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন চাইলেও কিছু বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে। পাশাপাশি দলটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোট চাইছে। এমন পরিস্থিতিতে পরামর্শকদের সঙ্গে আলোচনার পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কী সুপারিশ দেয়, তার দিকে তাকিয়ে আছে সরকারসহ রাজনৈতিক দলগুলো।
জানা যায়, মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) দুপুর ১২টায় এ-সংক্রান্ত সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেবে কমিশন।
তবে বাস্তবায়ন পদ্ধতি ও গণভোটের ব্যাপারে সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয় তার ওপর নির্ভর করছে গোটা পরিস্থিতি। সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন করলে বিএনপি মানবে কি না, সেই প্রশ্ন যেমন রয়ে গেছে। পাশাপাশি অধ্যাদেশ জারি করলে সেটির আইনি ভিত্তি নিয়েও ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠতে পারে। এ নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। আবার এই সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত না হলে স্বাক্ষর করবে না এনসিপি। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির অবস্থান কী হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানামুখী আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। এই আলোচনার সূত্র ধরে কোথাও কোথাও গুঞ্জনও তৈরি হয়েছে। বলা হচ্ছে, দলগুলোর মধ্যে এমন বৈরী পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে নির্বাচন কীভাবে হবে? গণ-অভ্যুত্থানে চাপে থাকা দলগুলো যেকোনো পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে পারে- এমন আলোচনাও আছে। আবার নির্বাচন না হলে তখন পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, সেটি নিয়ে সুধী সমাজের পাশাপাশি জনমনেও উদ্বেগ ছড়াচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময়সীমা ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হবে তো?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ খবরের কাগজকে বলেন, ‘জনগণ দলগুলোর জেদাজেদির পক্ষে নয়। তারা চায় সবকিছু সুষ্ঠুভাবে সমাধান হয়ে যাক। সব দল একমত হয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করছে, এটাই আমরা দেখতে চাই।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা তো প্রাইম মিনিস্টার। প্রাইম মিনিস্টারের অধ্যাদেশ জারির কোনো ক্ষমতা নেই। অধ্যাদেশ জারির ক্ষমতা আছে পার্লামেন্ট আর রাষ্ট্রপতির। এখন নির্বাচন না হলে দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। ফলে দলগুলোর উচিত হবে জুলাই সনদ ইস্যুতে নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করা।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না পেলে জাতীয় নির্বাচন ঝুলে যাবে। দেশ সংকটের দিকে যাবে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি হয়তো সব দলই দেবে। তবে আমি মনে করি, এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যের। এই ঐক্য হতে হবে নির্বাচনমুখী। কারণ জুলাই সনদের চেয়েও এখন মূল চ্যালেঞ্জ হলো সংসদ নির্বাচন আয়োজন।’
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ঘিরে কয়েক মাস ধরেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ দৃশ্যমান। বিশেষ করে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির জন্য গণভোট এবং এই সনদের ভিত্তিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা।বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিশ্চিত না হওয়ায় এখনো জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি এনসিপি।
সর্বশেষ গতকাল একটি জাতীয় দৈনিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেছেন, জুলাই সনদ নিয়ে লুকোচুরি হলে ভালো হবে না।
গত ১৭ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদে বিএনপিসহ ২৫টি রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করে। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও গণভোটের দাবিতে রাজপথে আন্দোলনে থাকলেও শেষ পর্যন্ত ওই দিনই জামায়াতে ইসলামীসহ সাতটি রাজনৈতিক দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করে। এনসিপিসহ পাঁচটি দল এখনো সনদে স্বাক্ষর করেনি। আর তিন দিনের মধ্যে (৩১ অক্টোবর) জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এর মধ্যে দলগুলোর স্বাক্ষর করার সুযোগ রয়েছে। এনসিপিও জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও সরকারের বিভিন্ন সূত্রগুলো জানাচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশন ও সরকারসংশ্লিষ্টরা পর্দার আড়ালে দফায় দফায় আলোচনা করে একটা সমঝোতায় পৌঁছার চেষ্টা করছেন।
যদিও এনসিপি বলছে, জুলাই সনদ আদেশ বাস্তবায়নের খসড়া হাতে পাওয়ার পর স্বাক্ষর করব কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তাদের যুক্তি, আগামী দিনে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে সংসদে এই সনদ পাস করবে, আইনি ভিত্তি দেবে তার নিশ্চয়তা কী?
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘জুলাই সনদের আদেশের খসড়ায় কী লেখা আছে, তা দেখে আমরা স্বাক্ষর করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। নির্বাচনের দিনে গণভোট হলেও আমাদের আপত্তি নেই। তবে গণভোটের মাধ্যমেই জনগণের অনুমোদন নিয়েই জুলাই সনদের বাস্তবায়ন হতে হবে।’
জানা গেছে, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বাস্তবায়নের জন্য কয়েকটি সুপারিশ উঠে এসেছে। একটি হলো- ৯ মাসের মধ্যে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা না হলে সংসদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে, এমন আদেশ জারির পক্ষে মত প্রকাশ করা হয়েছে। আরেকটি হলো, এমন বিধান করা যে নির্ধারিত সময়ে আগামী সংসদ সংস্কার প্রস্তাবগুলো পাস না করলে সেগুলো বাস্তবায়িত বলে গণ্য হবে।
সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত যে জায়গায় জুলাই সনদ আটকে আছে তা হলো, অধ্যাদেশ জারির পর সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে গণভোটের আয়োজন করা। গণভোটে জনগণ বাস্তবায়নের পক্ষে রায় দিলে সেটি মানা বাধ্যতামূলক বলে গণ্য হবে। তবে এই গণভোট জামায়াত ও এনসিপির দাবি অনুযায়ী নভেম্বরে, নাকি জাতীয় নির্বাচনের দিন একসঙ্গে হবে, সেটি বিএনপির সম্মতির ওপর নির্ভর করছে। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাদেশ জারি করলে সেটি ভবিষ্যতে উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন। কারণ বর্তমান সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অধ্যাদেশ সাধারণত রাষ্ট্রপতি জারি করে থাকেন। কিন্তু এনসিপি রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির বিরুদ্ধে।
যা বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ খবরের কাগজকে বলেন, ‘জুলাই সনদ এখন না থাকলেও রাষ্ট্র চলছে, ভবিষ্যতেও চলবে। তবে জুলাই সনদের উদ্দেশ্য হলো- গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য উপযোগী একটা রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করা। যেখানে ক্ষমতা ব্যক্তিকেন্দ্রিক থাকবে না। যে কারণে প্রধানমন্ত্রী কতদিন থাকতে পারবেন, দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি থাকতে পারবেন কি না- এসবের প্রশ্নের নিষ্পত্তি চাওয়া হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য হলো, ক্ষমতা যাতে ঘনীভূত হয়ে এক ব্যক্তির হাতে না যায়। এটা নিঃসন্দেহ ভালো। সেখানে নানা দলের নানা মত থাকতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আপত্তি বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে। এতে অনেকে মনে করছেন, বিএনপি সংস্কারের জন্য আন্তরিক না। ক্ষমতায় গিয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়া বিষয়গুলো যদি বাস্তবায়ন না করে। সেই কারণে সন্দেহ দেখা দিয়েছে- বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সেসব বাস্তবায়ন করবে কি না। সে জন্যই নির্বাচনের আগে দলগুলো গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ পাস করতে চাইছে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক খবরের কাগজকে বলেন, ‘সবাই আইনের ব্যাকরণের বাইরে কথা বলছেন, এর সঙ্গে আইনের কোনো সংযোগ নেই। জুলাই সনদ অধ্যাদেশের মাধ্যমে গণভোট হলেও পার্লামেন্ট সেটি বাতিল করতে পারবে। আগামী দিনে নতুন পার্লামেন্ট আইন পাস করতে পারে, আবার আইন বাতিলও করতে পারে। অর্থাৎ গণভোট অধ্যাদেশের ওই আদেশ পার্লামেন্টে বাতিল করার সুযোগ থাকবে। গণভোটের আইন বাতিল করে দিলে সেই আইনের অধীনে যা হয়েছে তাও বাতিল হয়ে যাবে। বছরের অন্তত চার-পাঁচবার সংসদে আইন বাতিল বা সংস্কার করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয়ত- যেকোনো আদেশ দিয়ে বা যেকোনো আইন দিয়ে পরবর্তী সংসদকে বিরত রাখতে পারবে না কেউ। একটা আইন করলে তা চিরকাল থাকবে, তা কিন্তু না। তারা বলছেন, প্রধান উপদেষ্টা আদেশ জারি করবেন, রাষ্ট্রপতি করবেন না। প্রধান উপদেষ্টা তো প্রাইম মিনিস্টার। প্রাইম মিনিস্টারের আইন জারির কোনো ক্ষমতা নেই। আইন জারির ক্ষমতা আছে সংসদ আর রাষ্ট্রপতির।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির জন্য গণভোটের বিকল্প নেই। গণভোট ও আইনি বৈধতা ছাড়া সনদের কোনো মূল্য নেই। আগামী দিনে টিস্যুর মতো যে কেউ ছুড়ে ফেলে দিতে পারে। আবারও ফ্যাসিবাদ তৈরি হতে পারে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি হয়তো সব দলই দেবে। প্রধান উপদেষ্টা হয়তো একটা দিকনিদের্শনা দেবেন, বিচার-বিশ্লেষণ করবেন। আমি মনে করি, জুলাই সনদে সব দলই স্বাক্ষর করবে। সংকটও কেটে যাবে। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে আরেকটা বড় নির্বাচন করা অনেক কঠিন ব্যাপার। সে জন্য জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদের চেয়েও এখন মূল চ্যালেঞ্জ হলো সংসদ নির্বাচন আয়োজন। নির্বাচনে অংশগ্রহণে সবার সদিচ্ছা থাকতে হবে এবং জনগণ যাকে ভোট দেবে তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় বসবে। একটি গণতান্ত্রিক ধারা শুরু হবে। নতুন বাংলাদেশের যে স্বপ্ন জনগণ দেখেছে, সেই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের শুরু হবে। নির্বাচন হয়ে গেলে সব সমস্যা কেটে যাবে। আমরা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের লক্ষ্য পূরণের দিকে অগ্রসর হতে পারব।’আমনে আগে একদম নিচে যাবেন।
শিপ্র/মোজউস/