নিজস্ব প্রতিবেদক
সুফল প্রকল্পে দেড় কোটি টাকা আত্মসাৎ: তদন্তহীন ‘হরিলুটে’ বন বিভাগের চক্র, অভিযুক্তদের পুরস্কারস্বরূপ পদোন্নতি
সুফল (টেকসই বন ও জীবিকা) প্রকল্পে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী বাগান সৃজন না করেও বরাদ্দের দেড় কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে বন বিভাগের একটি প্রভাবশালী চক্রের বিরুদ্ধে। দীর্ঘ এক বছর ধরে বিষয়টি বিভাগজুড়ে ‘ওপেন সিক্রেট’ হিসেবে ছড়িয়ে থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো তদন্ত শুরু হয়নি। বরং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো পদোন্নতি ও ‘প্রাইজ পোস্টিং’ দেওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে।
অভিযোগ রয়েছে, আত্মসাতের এই চক্রের মূলহোতা ডেপুটি রেঞ্জার সাদেকুর রহমান। প্রকল্পে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার পরও তাকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে সম্প্রতি ডেপুটি রেঞ্জার পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে কক্সবাজারের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জে রেঞ্জ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বও দেওয়া হয়—যা বন বিভাগের লোভনীয় পোস্টিং হিসেবে পরিচিত।
অভিযুক্ত তিন কর্মকর্তা
অভিযোগ রয়েছে, বনায়নের বরাদ্দ উত্তোলন শেষ হতেই তিন কর্মকর্তাকে বদলি করে ‘প্রাইজ পোস্টিং’ দেওয়া হয়, যাতে বিষয়টি ধামাচাপা যায়।
বনায়ন প্রকল্পের অর্থ লুটপাটের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে উপবন সংরক্ষক (ডিসিএফ) এস এম কায়সার এবং সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) জয়নাল আবেদীনের বিরুদ্ধেও। অভিযোগ উঠেছে, বরাদ্দের পুরো অর্থ উত্তোলনের পরই এই তিন কর্মকর্তাকে বদলি করে সুবিধাজনক পদে পাঠানো হয়, যাতে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়া যায়।
এদিকে কুমিরা রেঞ্জে বনায়ন না হওয়ার পরও নতুন যোগ দেওয়া বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সফিকুল ইসলাম কোনো ব্যবস্থা নেননি বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মোল্যা রেজাউল করিমের প্রভাবের কারণে তিনি আত্মসাতকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ এড়িয়ে যাচ্ছেন। বাগান সৃজন না করা বা নিম্নমানের বাগান করার দায়েও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
জানা গেছে, ২০২৩–২০২৪ অর্থবছরে কুমিরা রেঞ্জের ১৮০ হেক্টর এলাকায় বনায়ন করার কথা ছিল। এ বাবদ বনায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার ৮৮২ টাকা। নার্সারি থেকে চারা উত্তোলন ও রক্ষণাবেক্ষণের নামে খরচ দেখানো হয়েছে ৫৬ লাখ ১১ হাজার ৮০৬ টাকা। কিন্তু বিধি অনুযায়ী নার্সারিতে বীজ থেকে চারা উত্তোলন এবং জার্নাল সংরক্ষণ না করেই এসব খরচ দেখানো হয়। রক্ষণাবেক্ষণের নামে দেখানো হয় আরও ২৩ লাখ ১০ হাজার টাকা। শূন্যস্থান পূরণের নামে আত্মসাত করা হয় আরও ২০ লাখ টাকার বেশি। পলিব্যাগ, সার, বাঁশের খুঁটি কেনার খাতে দেখানো হয় প্রায় ১০ লাখ টাকা।
পরিদর্শন ও মূল্যায়ন ইউনিটের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর কুমিরা রেঞ্জের ১৭০ হেক্টর দ্রুতবর্ধনশীল বাগানের প্রথম জরিপে জীবিত চারাগাছের হার পাওয়া যায় মাত্র ৬০.২০%। একই রেঞ্জের আরও ১০ হেক্টরে জীবিত চারার হার ছিল ৫০.৪০%। যেখানে বিধি অনুযায়ী জীবিত চারার হার থাকা উচিত ছিল কমপক্ষে ৮০%। পরিদর্শন ইউনিটের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, জবরদখল হওয়া এলাকায় দখলদারদের লাগানো গাছের ফাঁকে ফাঁকে বাগান সৃজন দেখানো হয়েছে।
প্রথম জরিপে অনিয়ম ধরা পড়ার পর ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বিভাগ শতভাগ জীবিত চারাগাছ নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু নির্দেশনা অমান্য করে ২০% শূন্যস্থান পূরণ ও রক্ষণাবেক্ষণের নামে অর্ধকোটি টাকার বেশি খরচ দেখানো হলেও বাস্তবে বাগানে নতুন চারা রোপণ করা হয়নি। চলতি বছরের ১৯ আগস্ট করা দ্বিতীয় জরিপে দেখা যায়, ১৮০ হেক্টরের মধ্যে ৭০ হেক্টরে জীবিত চারার হার মাত্র ৩১.৬৫% এবং ১০ হেক্টরে মাত্র ২১.৬০%।
পরিদর্শন দল মন্তব্য করেছে, অনিয়ম আড়াল করতে কুমিরা রেঞ্জের কিছু এলাকায় সম্প্রতি খুব ছোট চারা রোপণ করা হয়েছে, যেগুলো শুষ্ক মৌসুমে টিকে থাকার সম্ভাবনা প্রায় নেই।
এ বিষয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, “বাগান সৃজনের সময় আমি দায়িত্বে ছিলাম না। তবে বাগান নির্দেশনা অনুযায়ী হয়নি, অনিয়ম থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বিভাগের ডিএফও মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, “জরিপ দলের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এদিকে বনায়নে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ জানতে ডেপুটি রেঞ্জার সাদেকুর রহমানের মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
শিপ্র/শাহোরা/