শিরোনাম :
ক্ষমতায় এলে গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের দায়িত্ব নেবে বিএনপি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ট্রাক ঢুকে পড়ল বাজারে; চাপা পড়ে নিহত ২; আহত ১০ বিচ্ছেদের চিন্তা উড়িয়ে সিঁথি ভর্তি সিঁদুরে কান উৎসবে ঐশ্বরিয়া টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে শেরপুরে বন্যার আশঙ্কা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে নারী কোটা বাতিল পদ্মায় বালুমহাল দখল কেন্দ্র করে দু’পক্ষের সংঘর্ষ; ৭ জন গুলিবিদ্ধ রায়পুরা প্রেসক্লাবের বাষির্ক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত মাসের ব্যবধানে ভোলপাল্ট আ.লীগ থেকে বিএনপিতে সাংবাদিককে জেলে ভরার হুমকি দিলেন ইউএনও বিইউবিটিতে জাতীয় পর্ব এআই অলিম্পিয়াড ২০২৫ সম্পন্ন
শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫, ০৮:৩১ অপরাহ্ন

সংসারে উপার্জন সক্ষম ছেলেকে হারিয়ে শয্যাশায়ী ডা. সজীবের মা

Reporter Name / ৩১ Time View
Update : মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই, ২০২৪

মো. শাহাদাৎ হোসেন রাজু 

সংসারে উপার্জন সক্ষম ছেলেকে হারিয়ে শয্যাশায়ী মা ঝর্ণা বেগম (৫৬)। ছেলের শোকে বিলাপ করছেন আর বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন। তারপরেও অশ্রুশীক্ত নয়নে তিনি বলছেন, আমি দীর্ঘদিন যাবত অসুস্থ। সজিব সবসময় আমাকে ছোট্ট সন্তানের মত আগলে রাখতো। আমিস সকলের খরচ যোগাতো সে। তার বাবার বয়স হয়েছে অবসরে যাবারও সময় হয়ে এসেছে। এখন কে আমাকে সন্তানের মত আগলে রাখবে বলতে বলতে আবারও মুর্ছা গেলেন ঝর্ণা বেগম। ছাপান্ন বছর বয়সি ঝর্ণা বেগমের প্রশ্ন— ‘কী দোষ ছিল আমার ডাক্তার ছেলের?’

তার এমন প্রশ্নের কারণ ‘পুলিশের’ গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন তার ছেলে ডা. সজীব সরকার (৩০)। পরিবারের দাবি অনুযায়ী, গত ১৮ জুলাই কোটা বিরোধী আন্দোলনে ‘কমপ্লিট শাটডাউনের’ মধ্যে ছোট ভাইকে আনতে গিয়ে ঢাকার আজমপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বড় ছেলে ডা. সজীব সরকার।

নিহত সজিব নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের মেঝেরকান্দি গ্রামের মো. হালিম সরকারের ছেলে। তিনি ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র লেকচারার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন ডা. সজীব।

রবিবার (২৮ জুলাই) বিকেলে নরসিংদী জেলা শহরের তরোয়া এলাকায় নিহত ডা. সজীব সরকারের ঝর্ণা বেগমের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ছেলেকে হারিয়ে তিনি এখন পাগল প্রায় অসুস্থ হয়ে অক্সিজেন নিচ্ছে। সাংবাদিকের কথা শুনতেই সবকিছু জেরে ফেলে দিয়ে সামনে জিজ্ঞাসু সুরে ‘ও বাবা কী দোষ ছিল আমার ডাক্তার ছেলের? বলেই ফেল ফেল করে তাকিয়ে ছিলেন এই প্রতিবেদকের মুখে দিকে। গুমোট ভাবটাকে স্বাভাবিক করতে প্রতিবেদক বললেন, আমি আপনার সব কথা শুনবো বলে উনাকে ধরে খাটে এনে বসালেন।

তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার দিন (১৮ জুলাই) আমার ছোট ছেলেকে আনতে বেলা ১১ টায় বাসা থেকে বের হন। বিকেল সাড়ে ৪ থেকে ৫ টার দিকে আমাকে ফোন করে বলে ‘মা আমি আজমপুর পৌঁছে গেছি আর কয়েক মিনিটের মধ্যে আব্দুল্লাহর মাদ্রাসায় পৌঁছে যাব তুমি কোন চিন্তা করো না। আমি আব্দুল্লাহকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিয়ে চলে আসব। রাত ১ টা পর্যন্ত ছেলের অপেক্ষায় বসে ছিলাম। ছেলে আমার ফিরে এসেছে ঠিক তবে জীবিত নয় লাশ হয়ে। বলতে পারেন – কী দোষ ছিল আমার ছেলের?’ বলেই প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন এই প্রতিবেদকের দিকে।

তিনি আবার বলতে শুরু করেন, আমাদের যা ছিলো সব ছেলেকে ডাক্তার বানাতে ব্যয় করেছি। সব হারিয়ে বলতে গেলে আমরা এখন নিঃস্ব। আপনারা কি বলতে পারেন আমার ছেলে হত্যার বিচার কি ভাবে পাবো? বলেই তিনি আবার মুর্ছা যান।

এসময় কথা হয় এমবিএ পড়ুয়া ডা. সজীব সরকারের একমাত্র বোন সুমাইয়া সরকারের সাথে। তিনি বলেন, গত ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার উত্তরার থানার আজমপুর এলাকার আশরাফুল উলুম মাদরাসায় পড়ুয়া ছোট ভাই আব্দুল্লাহকে আনতে নরসিংদীর বাসা থেকে বের হন। আজমপুর এলাকায় যখন বাস থেকে যখন থামলে সে সময় আন্দোলনকারী আর পুলিশের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছিল। বিকেল তখন সাড়ে ৫টা থেকে ৬টার মধ্যেবর্তী সময়। বাস থেকে নেমে আজমপুর আশরাফুল উলুম মাদরাসার উদ্দেশ্যে রাস্তার পাশ ধরে হাঁটতে থাকে। এ সময় পুলিশের ছোড়া গুলিতে নিহত হন আমার বড় ভাই। সন্ধ্যা ৭ টায় ভাইয়ের বন্ধুর মাধ্যমে খবর পেয়ে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে ছুটে যাই।সেখানে গিয়ে জানতে পারি বিকেলে আজমপুরের রাস্তা থেকে কয়েকজন লোক গুলিবিদ্ধ ভাইকে হাসপাতালে আসে। আমার ভাই আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এ অবস্থায় আমাদের এতো বড় সংসার কি করে চলবে?

নিহতের ভাই আব্দুল্লাহ বলেন, এর আগের সপ্তাহে ভাই মাদরাসায় এসেছিল। ওই সময় উনার সাথে সর্বশেষ দেখা হয়। তিনি যাবার সময় বলে গিয়েছিলেন আগামী ১৮ তারিখ বৃহস্পতিবার মাদরাসা ছুটি হলে তোমাকে এসে নিয়ে যাবো। আমার ১৮ তারিখ এসেছিলেন ঠিকই কিন্তু আমার কাছে পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি‌। এর আগে লাশ হয়ে গেলেন। সেদিন বিকেলে তিন বার ভাইকে ফোন দিয়ে না পেয়ে ব্যাগ নিয়ে উনার অপেক্ষায় বসে থাকি। রাত নয়টায় খবর পেয়ে হাসপাতালে এসে ভাইয়ের লাশ দেখতে পাই। রাতেই উত্তরার একটি মসজিদে গোসল করাতে গিয়ে দেখি ভাইয়ের বুকের সামনে দিয়ে গুলির বড় গর্ত হয়ে পিছন দিক দিয়ে বের হয়েছে। কাপড় তুলতেই দুই দিক দিয়ে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। দুই তিনটা রাইফেলের ক্ষত নীল জমাটবদ্ধ রক্ত।

আমার ভাইয়ের উপার্জনের টাকা দিয়ে ভাই বোনের পড়াশোনাসহ অসুস্থ মায়ের খরচ চলতো। ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেলো। এখন আমাদের কি করে চলবে?

১৮ তারিখ রাতেই উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে স্বজনরা ডা. সজীবের মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসে। পরদিন তাঁর মরদেহ নিজ এলাকায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

ডা. সজীব নিহত হওয়ার ১০ দিনের অধিক সময় পার হলেও এখনও থামেনি স্বজনদের কান্না। উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন সজিবের মৃত্যুতে এখন অথৈ সাগরে ভাসছে পুরো পরিবার।

নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মেঝেরকান্দি এলাকায় ডা. সজীবের কবর দেখতে গিয়ে সেখানে দেখা মেলে নিহতের বাবা মো. হালিম সরকার (৫৮) এর সাথে। ‘ওরা কেন আমার ছেলেটাকে কেড়ে নিলো? আমার ছেলে তো কারও ক্ষতি করেনি। আমি এখন কার কাছে বিচার চাইবো? আমার সজীবকে তোমরা এনে দাও।’

এভাবেই কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বিলাপ করছিলেন
ডা. সজীবের বাবা। এসময় বলেন, ছেলেকে খুব কষ্ট করে ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে পঞ্চম থেকে এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করাই। পরে টঙ্গীর বেসরকারি তাইরুন্নেছা মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে ভর্তি করাই। গত ২০২০ সালে থেকে এমবিবিএস পাশ করে চিকিৎসক হন। তাকে চিকিৎসক বানাতে গিয়ে দিতে হয়েছে সর্বত্র, ঋণে হতে হয়েছে জর্জরিত। ইদানীং সে আমার এই ঋণগ্রস্ত পরিবারের হাল ধরেন। তার উপার্জনে অসুস্থ মা’র চিকিৎসা ও ভাই-বোনের পড়াশোনাসহ কিছু কিছু করে ঋণ পরিশোধ করতো। তাকে ঘিরে আমরা কতইনা স্বপ্ন বুনেছিলাম। আমার ছেলের মৃত্যুতে আমার যে কত বড় ক্ষতি হয়েছে তা বলে বুঝাতে পারবনা।
তার কি অপরাধ ছিল তার যে তাকে এভাবে গুলি মেরে ফেলা হলো। আমরা কার কাছে বিচার চাইব? কে করবে বিচার, কে দিবে ক্ষতিপূরণ? যা সহায় সম্বল কামাই ছিলো সব ছেলে ডাক্তার বানাতে ব্যায় করেছি। ছেলে আমার ছায়া ছিলো, এখন আমার সব শেষ। আমি আওয়ামী লীগের একজন নগন্য কর্মী হিসেবে ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে এটাই কি আমার প্রাপ্য ছিলো।

ছেলে আমার খুব ধার্মিক ছিলেন। অনেক কষ্ট করে ছেলেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়াশোনা করিয়ে দেশের সেবক বানিয়েছি। অথচ রাষ্ট্র আমাকে দিল ছেলের লাশ। আমি শত কান্নাকাটি করলেও ছেলেকে আর ফিরে পাবোনা। আমরা চাই সঠিক তদন্ত সাপেক্ষে আমার ছেলে হত্যার বিচার। তাইলেই তার আত্মা ও আমরা শান্তি পাবো।’

এসময় নজরুল ইসলাম নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, সজিব ডাক্তারি পাশ করার পর সময় পেলেই এলাকায় এসে বিনামূল্যে মানুষের চিকিৎসা সেবা দিতেন। তার মৃত্যু সত্যিই মেনে নেওয়া যায়না। খুব ভালো মনের পরহেজগার মানুষ ছিলেন।

শিপ্র/শাহোরা/


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!