নিজস্ব প্রতিবেদক
নরসিংদীর মাঠে মাঠে কৃষকদের ব্যস্ততার যেন কমতি নেই। ফসলের মাঠগুলোতে শীতকালীন সবজি চাষে ধুম পড়েছে। কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু করে সন্ধ্যার পূর্ব সময় পর্যন্ত চারা রোপন, পরিচর্চা, নিড়ানি দেওয়া, কীটনাশক ছিটানো, বেড়ে উঠতে থাকা চারার গোড়ায় গোবর বা জৈব সার দেওয়া, মাঁচা বাধাসহ শীতকালীন সবজি চাষে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে।
আর কয়েক দিনপর জেকে বসবে শীত। তাই নরসিংদী জেলার বিভিন্ন এলাকায় ইতোমধ্যে শীতকালীন সবজির চাষ শুরু হয়েছে। আরও অনেক আগেই শীতকালীন সবজি চাষ শুরু করার কথা থাকলেও ়সেপ্টেম্বরের শেষে ও অক্টোবরের শুরুতে কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে জেলায় শীতকালীন সবজি চাষ ব্যাহত হয়েছে। যার ফলে জেলার কৃষকদের অনেকটা দেরিতেই শুরু করতে হয়েছে শীতকালীন শাকসবজি চাষাবাদ। আবার জেলার অনেক কৃষক আগাম শীতকালীন সবজি চাষবাদ করলেও টানা বৃষ্টিতে তা বেস্তে গেছে। বৃষ্টির পানিতে সবজির চারাগুলোর গোড়ার পচন ধরে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ক্ষতির মুখে পড়ে জেলার আগাম শীতকালীন সবজি চাষীরা।
দেরিতে চাষাবাদ শুরু করলেও জেলার অনেক কৃষকই মনে করছে শীতকালীন সবজি চাষের জন্য এখনই উপযুক্ত সময়। এ সবজি বাজারে তুলতে পারলে ভালো দাম পাবেন, তাই কৃষকরা সে আশায় ফসলের বাড়তি যত্ন নিচ্ছেন।
কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নরসিংদীর ৬ টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সবজি চাষ হয় শিবপুর, বেলাব, মনোহরদী ও রায়পুরা উপজেলায়। এসব উপজেলার বিভিন্ন এলাকার শত শত চাষি সবজি চাষে জড়িত। তারা বেগুন, করলা, পটল, শসা, কাকরোল, বরবটি, চিচিংগা, ঝিঙা, চাল কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, করলা, লালশাক, ডাটাশাক, কচু, আলু, ঢেঁড়স, পেঁপে, মূলা, বাঁধাকপি, ফুলকপি ও মরিচসহ সৃজনারী বিভিন্ন প্রকারের সবজি চাষ করেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে নরসিংদী জেলায শীতকালীন শাকসবজি চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমি। এ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকের বেশী জমিতে শীতকালীন শাকসবজির আবাদ করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহখানেকের মধ্যে বাকী জমিতে অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে মনে করছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। চলতি মৌসুমে শীতকালীন সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৩৬৬ মেট্রিক টন। জেলায় সবচেয়ে বেশি সবজি চাষ হয় শিবপুর উপজেলায়।
সরেজমিন জেলার বিভিন্ন সবজির মাঠ ঘুরে দেখা যায়, চাষিরা তাদের জমিতে শীতকালীন সবজি চাষে চারা প্রস্তুত করেছেন। প্রায় প্রতিটি সবজি ক্ষেতে এক কোনায় চারা উৎপাদনের বীজতলার সেট তৈরি করা আছে। আবার অনেকে চারা উৎপাদন না করে বাইর থেকে চারা কিনে চাষাবাদ করে থাকে। সরেজমিন কোথাও কোথাও দেখা যায়, বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে শোভা পাচ্ছে সারি সারি শিমগাছের মাচা, ফুলকপি, বাধাকপি, লাউ, বেগুন, মূলা, করলা, পটল, শসা, পালংশাক, লালশাক ও পুইশাকসহ হরেক রকম শীতকালীন সবজি চারা রোপন করা হয়েছে। ফুলকপি ও বাধাকপির ক্ষেত্রে চারা রোপণের ৬০ দিনের মধ্যে তা বিক্রির উপযুক্ত হয়। ইতোমধ্যে লাউ, ঝিঙা, মূলা বাজারে উঠতে শুরু করছে। শিম, টমেটো কিছুদিনের মধ্যেই বাজারে উঠবে। বেশির ভাগ কৃষকই আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে কীটনাশকমুক্ত সবজি চাষ করছেন। এতে করে সবজির গুণগত মান ভালো থাকে এবং বাজারে চাহিদাও বেশি থাকে।
শিবপুর উপজেলার কুন্দারপাড়া গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমান। তিনি বানিজ্যিক ভিত্তিতে সবজির রোপন করেন। তিনি বলেন, সবজির চারা রোপণের আগে জমি তৈরি করে কিছুদিন রাখা হয়। এতে চারাগুলো রোগবালাই প্রতিরোধের ক্ষমতা সঞ্চয় করে এবং গাছগুলো সবল হয়। এ বছর বৃষ্টিপাতের দুই দফায় আমার চারা নষ্ট হয়। বর্তমানে তৃতীয় দফা চারা রোপন করে বিক্রি করছি। এবছর অন্যান্য বছরের তুলনায় চারা দাম ভালো পাচ্ছি। সামনের দিনগুলোতে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আশা করছি আমার যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে পারবো।
শিবপুর উপজেলার উপজেলার ব্রাহ্মন্দী এলাকার কৃষক মজিবুর রহমান বলেন, আমি প্রতিবছর ৪ বিঘা জমিতে আগাম সবজি চাষ করি। তবে এ বছর মৌসুমের শুরু জমি সবজি চাষের উপযোগি করতে না পারায় মাত্র ১ বিঘা জমিতে আগাম সবজি হিসেবে ফুলকপি চাষ করলেও টানা বৃষ্টিতে তা নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তী ওই জমিসহ ৪ বিঘা জমিতে ফুলকপি বাধাকপি ও শিম চাষ করেছি। কোনো রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে আশা করছি ক্ষতি পুষিয়ে লাভবান হতে পারবো।
সবজি চাষি ফরিদ মিয়া জানান, এ বছর শীতকালনি সবজি চাষে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। তিনি ২ বিঘা জমিতে ফুলকপি, মূলা ও লাউয়ের চারা রোপণ করছেন। তবে এতে তার আশানুরূপ ফলন হবে বলে তিনি মনে করছেন।
বাঘাব ইউনিয়নের কৃষি উপসহকারী কর্মকর্তা জোসনা বেগম জানান, শীতের আগাম সবজি চাষ করে কৃষকরা অনেকটা লাভবান হয়। ফলে এলাকার কৃষকরা আগাম সবজি চাষে ঝুকছে। কিন্তু চলতি বছর টানাবৃষ্টিতে শীতকালীন আগাম সবজি চাষ অনেকটাই ব্যাহত হয়। আমরা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা প্রণয়ন করেছি। পাশাপাশি কৃষকদের আমরা তাদেরকে চাষাবাদের বিভিন্ন প্রযুক্তি সম্পর্কে পরামর্শ দিচ্ছি।
নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আজিজুর রহমান জানান, চলতি মৌসুমে নরসিংদী জেলায় ১০ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কৃষকরা সবজি চাষে যাতে ভালো ফলন পায় সে বিষয়ে তাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করেছেন কৃষি বিভাগ। চলতি বছর টানাবৃষ্টিতে জেলার অনেক সবজি চাষী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলায় ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকের সংখ্যা ৩ হাজার জন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে শীতকালীন হাইব্রিড ও উফশি জাতের সবজি বীজ এবং ডিএপি ও এমওপি সার বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক কৃষককে এক হাজার টাকা করে নগদ প্রদানের জন্য প্রণোদনা পাওয়া গেছে।
শিপ্র/শাহোরা/