নিজস্ব প্রতিবেদক
নরসিংদী জেলা জুড়ে আগাম জাতের আমন ধান কাটা-মাড়াই শুরু হয়েছে। অল্প সময়ে ধান ঘরে তুলতে পারায় আগাম জাতের ধান চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে কৃষকের কাছে। বিশেষ করে এই ধান কাটার পর একই জমিতে আলু, সরিষা, পেঁয়াজসহ শীতকালীন শাক-সবজি চাষাবা করে লাভবান হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন কৃষকরা।
নরসিংদীতে অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে পাকা আমন ধানের সোনালি রঙে সেজেছে মাঠের পর মাঠ। মাঠগুলোতে যতদূর চোখ যায় শুধু পাকা ধানের সোনালি রূপ। কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ ধান কাটা-মাড়াই ও ঘরে তোলার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
জানা যায়, নরসিংদী সদর, পলাশ, শিবপুর, মনোহরদী, বেলাব, ও রায়পুরা উপজেলার মাঠঘাট জুড়ে সোনালী বর্ণ ধারণ করা আমন ধানের নয়নাভিরাম দৃশ্য এখন চোখে পড়ার মতো। ধানের আভা দেখে উচ্ছ্বাসে ভরে উঠেছে কৃষকের মন-প্রাণ। চলতি রোপা আমন মৌসুমে উচ্চ ফলনশীল ও স্বল্প জীবনকালীন আগাম জাতের ব্রিধান-৭৫, ব্রি ধান-৯৩, এবং বিনা-৭ ও বিনা-১৭ ধান কাটা শুরু হয়েছে।
নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি রোপা আমন মৌসুমে জেলায় ৪১ হাজার ২০৫ হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল, কিন্তু মৌসুমের শুরুতে কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এ বছর জেলায় ৪১ হাজার ১৪০ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষাবাদ হয়। যা আবাদের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬৫ হেক্টর কম। আবাদকৃত জমির মধ্যে স্বল্পকালীন জীবনের আগাম জাতের ধানের আবাদ হয়েছে ৬ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে। যা মোট আবাদের ১৬.৬৫ শতাংশ। এবছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৩২ হাজার ৪৯৩ মেট্রিক টন। জেলার ৬ উপজেলায় উঁচু জমিতে কৃষকরা বিভিন্ন জাতের আগাম ধান আবাদ করেছেন। এসব জাতের ধান ফলনও ভালো হয়, আবার কার্তিকের শুরুতেই ঘরে তোলা যায়। সেই সাথে উৎপাদিত খড় দিয়ে গো-খাদ্যেরও সংকট অনেকাংশে মেটে।
কৃষকরা বলছেন, প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না হওয়ায় এবার বাম্পার ফলন হয়েছে আগাম জাতের ধানের। সেই সাথে ধান কাটার পর একই জমিতে আলু, সরিষা, পেঁয়াজসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করে লাভবান হওয়ার আশা করছেন তারা।
নরসিংদী সদর উপজেলার মহিষাশুড়া ইউনিয়নের বালুসাইর গ্রামের কৃষক মো. খয়ের মিয়া বলেন, আমরা বিনা-১৭ ধান রোপণ করি। কারণ এটা একটু আগে কাটা যায় এবং ধান কাটার পর অন্য একটি ফসল আমরা আবাদ করতে পারি।
শিবপুর উপজেলার লেটাব এলাকার কৃষক মকবুল হোসেন বলেন, আগাম ২ বিঘা জমিতে ব্রি ধান ৭৫ জাতের ধান আবাদ করেছি। কেটে বাড়িতে নেওয়ায় হয়েছে। ফলনও ভালো হয়েছে। এখন আবার জমি তৈরি করে সরিষা আবাদ করার চিন্তা করছি।
কৃষকরা জানিয়েছেন, এ বছর ফলন তুলনামূলক ভালো হয়েছে। প্রতি মণ ধান বিক্রি করছেন ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা দরে। তাছাড়া আগাম জাতের ধান কেটে এই জমিতেই বাড়তি ফসল হিসেবে সরিষা, আলুসহ শীতকালীন সবজি আবাদ করতে পারবেন তারা। তাই প্রতিবছরই জেলায় বৃদ্ধি পাচ্ছে আগাম জাতের রোপা আমন ধানের চাষ।
রায়পুরা উপজেলার আদিয়াবদ গ্রামের কৃষক মো. মোস্তফা বলেন, আমরা হাইব্রিড জাতের বিনা-৭ ও ব্রিধান-৯৩ জাতের ধান রোপণ করেছি। পাশাপাশি কিছুটা জমিতে ব্রি ধান-৩৪ জাতের চিকন ধান রোপণ করেছি। এ বছর আল্লাহ দিলে ধান ভালোই হয়েছে। ধাপে ধাপে বৃষ্টি হওয়ার কারণে ধানের ফলনটা ভালো হয়েছে।
চলতি রোপা আমন মৌসুমে ধানে রোগ ও পোকার আক্রমণ একবারেই ছিল না। পাশাপাশি কৃষক পর্যায়ে সারের সরবরাহ ভালো থাকায় কৃষকরা সুষম পরিমাণে জমিতে সার ব্যবহার করতে পেরেছেন। যে কারণে ফলন ভালো হয়েছে। সে হিসেবে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার খুব কাছাকাছি পৌঁছানো যাবে।
মাঠে মাঠে আমন ধানের সোনালী রঙে কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। জেলার বিভিন্ন মাঠে আমন ধান কাটা ও মাড়াইয়ের ধুম পড়েছে। বাম্পার ফলন পেয়ে খুশি কৃষকরা। শীতল বাতাসে পাকা সোনালী আমন ধান দোল খাচ্ছে মাঠে মাঠে। পাকা ধানের গন্ধে কৃষকদের মনে এখন বইছে প্রফুল্লতা। পাকা ধান কেটে ঘরে তুলতে জেলার কৃষকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন।
তাদের মনে স্বপ্ন জেগেছে নতুন চালের ভাতের পাশাপাশি পরিবার, পরিজন, নাতি-নাতনিকে নিয়ে পিঠে খাওয়ার উৎসবে মেতে উঠবেন। পাকা ধান কাটতে হাতে কাঁচি নিয়ে মাঠে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকেরা। মাঠ থেকে নতুন ধান বাড়িতে তোলার জন্য খুশিতে আজ্ঞিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছেন কৃষাণীরা। পাকা ধানে ভরে উঠবে কৃষকের গোলা।
ধান ক্ষেত থেকে কৃষকের বাড়ির উঠোন, সবখানে এখন কৃষক কৃষানীর ব্যস্ততা। মাঠে মাঠে শুরু হয়েছে ধান কাটা ও মাড়াই। অগ্রহায়ণে পুরোদমে ধান কাটা-মাড়াই মৌসুম শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে অনেকেই কাটা ও মাড়াইয়ের ধান বাজারে বিক্রিও শুরু করছেন। বাজারে ভালো দাম পেয়ে কৃষকের মুখে হাঁসি ফুটেছে।
নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আজিজুর রহমান জানান, চলতি মৌসুমে জেলায় আমন ধানের লক্ষ্যমাত্রা ৪১ হাজার ২০৫ হেক্টর জমি। এরমধ্যে আবাদ হয়েছে ৪১ হাজার ১৪০ হেক্টর জমিতে। যা থেকে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৩২ হাজার ৪৯৩ মেট্রিক টন। এবার গড় ফলন প্রায় ১৬ মণ। জেলায় আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষকরা এখন ধান কেটে ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
শিপ্র/শাহোরা/