অর্থনীতি ডেস্ক
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। সবশেষ এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকার বেশি।
দেশের ব্যাংক খাতের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে খেলাপি ঋণ। এই ফোঁড়ার ব্যথা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। নামে-বেনামে ঋণ প্রদান আর ফেরত না দেয়ার সংস্কৃতি ভোগাচ্ছে পুরো ব্যাংক খাতকে। অবশ্য সব ব্যাংকের ক্ষেত্রে বাস্তবতা এটি নয়। তবে পুরো খাতের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে খেলাপি ঋণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। এটা দেশের সব ব্যাংকের প্রদেয় ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের ৬৪টি ব্যাংক মিলে যত ঋণ দিয়েছে তার সাড়ে ১২ ভাগের বেশি খেলাপি হয়ে পড়েছে।
শঙ্কার বিষয় হলো, খেলাপি হয়ে পড়া এসব ঋণের অর্থ ফেরত আসার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। অর্থনীতিবিদরা বার বার সতর্ক করা সত্ত্বেও খেলাপির সংস্কৃতি থেকে ব্যাংক খাত বেরিয়ে আসতে পারছে না। তাদের ধারণা, খেলাপি হয়ে পড়া ঋণের অর্থের বড় অংশই দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে।
সদ্য পদত্যাগ করা আওয়ামী লীগ সরকারের নানামুখী ব্যর্থতার মধ্যে অন্যতম এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ। একের পর এক ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া আর ঋণ জালিয়াতি বন্ধ করতে না পারার ব্যর্থতা আওয়ামী লীগ সরকারের বড় দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, গত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাত থেকে লোপাট হয়েছে প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা। আর সেই অর্থ ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না সংস্থাটির গবেষকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি।
তিন মাস আগে মার্চ প্রান্তিকে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিলো ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ঋণ ছিলো এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি। অর্থাৎ চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। আর এই সময়টাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন আবদুর রউফ তালুকদার।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।
জানা গেছে, এসব খেলাপি ঋণ নিয়ে যারা দেশের বাইরে অর্থ পাচার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে তাদের সম্পদের খোঁজে কাজ শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইতোমধ্যে পাচারের অর্থ পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন দেশকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট- বিএফআইইউ। পাশাপাশি এসব ঋণখেলাপির দেশের ভেতরের সম্পদ জব্দে জোর চেষ্টা চলছে বলেও জানা গেছে। এসব অর্থ আত্মসাৎকারীরর বিদেশে থাকা সম্পদ ফিরিয়ে আনতে সরকারও জোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
বিএফআইইউ থেকে জানা গেছে, আর্থিক খাতের বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান এস আলম, সামিট, বসুন্ধরা, বেক্সিমকো, ওরিয়নসহ অনেক গ্রুপের তথ্য চেয়ে একাধিক দেশে চিঠি দেয়া হয়েছে। আর সুনির্দিষ্ট তথ্য চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশে।
তৎকালীন সরকারের সুনজরে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে প্রভাব খাটিয়ে অর্থ পাচারের পুরো চিত্র বের করতে চেষ্টা চলছে বলেও জানা গেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গণমাধ্যমে দেয়া নিজের বক্তব্যে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নামে-বেনামে কত টাকা পাচার করেছে তা হিসাব করা হচ্ছে।
এরই মধ্যে দেশের অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র তৈরি করতে কমিটি করে দিয়েছে সরকার। ওই কমিটি দেশের ব্যাংক খাতের পুরো চিত্র জাতির সামনে তুলে ধরবে বলে জানিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে খেলাপি ঋণের পুরো চিত্র উঠে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শিপ্র/শাহোরা/