নিজস্ব প্রতিবেদক
বৃষ্টির সুবাদে দেশজুড়ে টানা তাপদাহের উপশম হলেও ডিম আর মুরগির চড়া দামে গরম হয়ে আছে বাজার। সপ্তাহের ব্যবধানে ডিমের দাম ডজনে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়। অন্যদিকে ১৫ দিনের ব্যবধানে সোনালি মুরগির দাম কেজিতে ৮০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১০ থেকে ৪২০ টাকায়। ব্রয়লার মুরগির দামও কেজিপ্রতি ৩০ টাকা বেড়ে ২১০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কয়েকদিনের মধ্যে ডিম ও মুরগির দাম এমন অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন খরচের চাপও অনেকখানি বেড়ে গেছে।
দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বলছেন, গত ১ এপ্রিল থেকে শুরু করে টানা ৩৬ দিনের তাপদাহের কারণে দেশের বিভিন্ন জেলায় কয়েক লাখ ব্রয়লার, লেয়ার ও সোনালি মুরগি মারা যায়। সে কারণে এখন ফার্মের মুরগির ডিম, ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম বেড়ে গেছে।
সরেজমিন গতকাল শুক্রবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার, তেজগাঁওয়ের কলমিলতা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা হালি। এক ডজন কিনলে দাম রাখছে ১৪৫ টাকা। সাদা ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা হালি। পাইকারি পর্যায়ে ১০০ লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৭০ টাকা।
খুচরা ডিম ব্যবসায়ী মুস্তাফিজুর রহমান জানান, এক সপ্তাহের ব্যবধানে ১০০ লাল ডিমে ১৩০ টাকা বেড়েছে। আরেক ডিম ব্যবসায়ী আরিফুল ইসলাম জানান, ১০০ সাদা ডিম বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩০ টাকায়। এক মাসের ব্যবধানে ১০০ ডিমে ২৫০ টাকা বেড়েছে। চাহিদা অনুযায়ী জোগান ঠিক থাকলেও দাম বাড়ছে।
জোগান কম- দাবি ব্যবসায়ীদের
হঠাৎ ডিমের দাম কেন এতো বাড়লো তা জানতে চাইলে তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. আমান উল্লাহ বলেন, রমজান মাসে ডিমের চাহিদা কম ছিল, দামও কম ছিল। বর্তমানে বাজারে চাহিদা অনুযায়ী ডিমের সরবরাহ নেই। এপ্রিলের তাপপ্রবাহে কয়েক লাখ মুরগি হিট স্ট্রোকে মারা গেছে। গরমের কারণে ডিমের উৎপাদনও কমে গেছে। এ অবস্থায় অনেক খামারি পথে বসে গেছেন। আবহাওয়া যদি ভালো থাকে তাহলেও ডিমের বাজার ঠিক হতে তিন মাসের বেশি সময় লাগবে। এ সময়ের মধ্যে দাম বাড়তেই থাকবে।
তিনি আরও বলেন, আমি নিজে গত বুধবার ১০০ লাল ডিম কিনেছি ১ হাজার ৪০ টাকায়, বৃহস্পতিবার তা ১ হাজার ৬০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে। তারপরও ডিম নেই। বর্তমান অবস্থায় ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দাম বাড়াতে পারবে না বলেও দাবি করেন তিনি।
একই সমিতির সেক্রেটারি আবু হানিফ মিয়া বলেন, আমরা তেজগাঁওয়ে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ লাখ পিস ডিম বিক্রি করি। বর্তমানে আমদানি ১২ থেকে ১৪ লাখ পিস। সারা দেশে ৪ থেকে সাড়ে ৪ কোটি পিস ডিম বিক্রি হয়।
সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর ব্যাপারে তাদের কোনো হাত নেই বলে দাবি করেন এই সমিতির দুই নেতাই। বাংলাদেশ এগ প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তাহের আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ডিমের দাম আর কত বাড়বে সেটি বলা সম্ভব নয়। আমরা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ডিম পাচ্ছি না।
বেড়েছে মুরগির দামও
শুক্রবার মহাখালী কাঁচাবাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ২১০ থেকে ২২০ টাকায়। আর সোনালি মুরগি বিক্রি হয়েছে ৪১০ থেকে ৪২০ টাকা কেজি। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে সোনালির দাম ৮০ টাকা ও ব্রয়লারের দাম ৩০ টাকা বেড়েছে। প্রতি কেজি দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায়।
বাজার করতে আসা তৌহিদুল ইসলাম জানান, ২২০ টাকা কেজি দরে একটি দেড় কেজি ওজনের ব্রয়লার কিনেছেন তিনি। তার ভাষায়, আসলে ব্রয়লারের দাম এত হওয়ার কথা নয়।
মুরগি কিনতে এসে ক্ষোভ প্রকাশ করে ফরিদ আহমেদ নামে এক ক্রেতা বলেন, সোনালি মুরগির দাম হঠাৎ করে এত বেড়ে গিয়ে ৪০০ ছাড়িয়েছে, এটা অকল্পনীয়। অসাধু ব্যবসায়ীরা যখন যা ইচ্ছা তাই করবে, এসব কী দেখার কেউ নেই? বাজারে তদারকি বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।
ডিমের বাজারের নিয়ন্ত্রক তেজগাঁওয়ের ব্যবসায়ীরা
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, ডিমের দামটা সব সময় ইউটার্ন নেয়। এক ইউটার্নে বাড়ে, অপরটিতে কমে। ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ডিমের দাম খামারি পর্যায়ে প্রতি পিস ৮ টাকা ২০ পয়সা ছিল। ২ মে পর্যন্ত ছিল ৮ টাকা ৮০ পয়সা। ৩ থেকে ৯ মে পর্যন্ত ১০০ সাদা ডিমে দাম বেড়েছে ২১০ টাকা ও লাল ডিমে ২৭০ টাকা। মূলত খামারিদের কাছ থেকে কম দামে ডিম কেনা হয়েছে ও তাদের ক্ষতি হয়েছে। সেই ডিমের দাম বাড়িয়ে বর্তমানে পুরো টাকা ব্যবসায়ীরা নিয়ে গেছেন। এই অতিরিক্ত ব্যবসা করেছেন ঢাকা ও রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও কিশোরগঞ্জের ডিম ব্যবসায়ীরা। ঢাকার ব্যবসায়ীরা যে দাম নির্ধারণ করেন সেটি তারা ফেসবুকে দিয়ে দেন। সে অনুযায়ী সারা দেশে দাম নির্ধারিত হয়। বর্তমানে যে দামে ডিম বিক্রি হচ্ছে তা খামারিদের বাঁচিয়ে রাখতে সহায়তা করবে। কেননা কোনো খামারি নগদ টাকায় খাবার খাওয়ালে ডিমের উৎপাদন ব্যয় পড়ে সাড়ে ৯ টাকা। আর বাকিতে কিনে খাওয়ালে পড়ে সাড়ে ১০ টাকা।
বর্তমানের সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দুটি দাম নির্ধারণ করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, একটি দাম থাকবে শীতকালের জন্য, অপরটি গরমের। এ দাম নির্ধারণে সরকারি দপ্তর, ডিম ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারী তথা প্রান্তিক খামারিরা মিলে কাজ করতে হবে। স্টোরে ডিম রেখে ব্যবসায়ীরা লাভ করলেও খামারিদের প্রতি ডিমে ৩ টাকা ক্ষতি হয়ে গেছে। সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে হলে রাতে ডিম বিক্রি বন্ধ করতে হবে।
ফেসবুকের মেসেজের মাধ্যমে দাম নির্ধারণ
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডিম কবে কত টাকায় বিক্রি হবে তা ঠিক করে দেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করছেন। তেজগাঁও সমিতির নামে একটি ফেসবুকের গ্রুপে গত ৭ এপ্রিলের পোস্টে দেখা গেছে, সেখানে ১০০ সাদা ডিমের দাম ৭৩৫ ও লাল ডিম ৭৫৫ টাকা রাখতে বলা হয়েছে। ১৪ এপ্রিল সাদা ডিম ৮৩০ ও লাল ডিমের দাম ৮৬০ টাকা রাখতে বলা হয়। ৫ মে কাজী ফার্ম লিমিটেডের ফেসবুক পেজে সাদা ডিম ৭০ ও ও লাল ডিম ৬০ টাকা বেড়েছে বলে জানানো হয়। একই দিন সোনালি এস এল ডিমের ঘর নামের অপর ফেসবুক পেজে সাদা ডিম ৯৮০ ও লাল ১ হাজার ৩০ টাকা বলে জানানো হয়। গত বৃহস্পতিবার একটি ফেসবুক পেজে দেখা যায়, লাল ডিমের বাজার ১০ ও সাদা ডিমের বাজার ২০ টাকা বেড়েছেÑ এমন তথ্য পোস্ট করা হয়েছে। গতকাল মেসার্স ডি-এস এন্টারপ্রাইজ ও আমরা পোল্ট্রি খামারি, তেজগাঁও সমিতির ফেসবুক পেজে লাল ও সাদা ডিম ৩০ টাকা বেড়েছে বলে জানানো হয়। এ ছাড়াও হালালভাবে ব্যবসা করুন, প্রতিদিনের ডিমের বাজার দর, রিফাত ডিমের আড়ৎ, ডিম বাজার, এসএস পোল্ট্রি ফার্ম, ইমিনা এন্টারপ্রাইজ, পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি রাজশাহীসহ বিভিন্ন ফেসবুক পেজ থেকে প্রতিনিয়ত ডিমের দাম নির্ধারণ বা এ-সংক্রান্ত বিভিন্ন বার্তা দেওয়া হচ্ছে।
বাচ্চা আমদানির অনুমতি চান খামারিরা
দেশের পোল্ট্রি শিল্প বিকশিত হলেও সে অনুযায়ী বাচ্চা উৎপাদনে হ্যাচারি গড়ে ওঠেনি। অল্প কয়েকটি করপোরেট কোম্পানি বাচ্চা উৎপাদন করছে। এ অবস্থায় এক দিন বয়সি বাচ্চা আমদানির অনুমতি চান খামারিরা।
বিপিএ সহসভাপতি বাপ্পা সাহা বলেন, প্রায় তিন মাস যাবৎ লেয়ারের (ডিমের মুরগি) বাচ্চা পাওয়া যাচ্ছে না। সপ্তাহে লেয়ার বাচ্চার চাহিদা ১৫ লাখ। ৫ হাজারের চাহিদার জায়গায় হ্যাচারি মালিক এক হাজার বাচ্চা দিচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে রেট প্রতিটি বাচ্চা ৫৩ টাকা হলে কিনতে হচ্ছে ১১০ টাকায়। তারপরও অগ্রিম টাকা দিয়ে চাহিদামতো বাচ্চা পাওয়া যায় না। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ছয় মাস পরে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে প্রতিটি ডিমের দাম দাঁড়াবে ২০ টাকা।
এক দিনের বাচ্চা আমদানির অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর আমদানির অনুমতি না দেওয়ায় প্রান্তিক খামারিরা আমদানি করতে পারেন না। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় আমদানির কোনো বিকল্প নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সুবাস চন্দ্র দাস বলেন, দাম বেড়ে গেলে ও একেবারে কমে গেলে পোল্ট্রি শিল্প নিয়ে কথা হয়। দীর্ঘমেয়াদি ও সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ নেই। দাম বাড়ার সঙ্গে হিট স্ট্রেসের সম্পর্ক রয়েছে। ব্রয়লারের ক্ষেত্রে ১৮ থেকে ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহনীয়, ২৮ থেকে ২৯ ডিগ্রি কষ্টকর এবং ৩২ থেকে ৩৩ হলে কষ্টের মাত্রা বাড়ে। কিন্তু ৩৮ ডিগ্রি বা তার বেশি হলে তা ভয়াবহ। ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা ২৪ ঘণ্টা থাকলে এর প্রভাব এক ধরনের। আবার টানা ৭ দিন থাকলে সেটির ফলাফল আরেক ধরনের। দেশে এপ্রিল থেকে টানা এক মাসের বেশি তাপপ্রবাহ গেছে। এই তাপমাত্রায় অনেক ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগি মারা গেছে। এতে ডিম উৎপাদন কমেছে। তবে এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন আসে, বাজারমূল্য যেভাবে বেড়েছে সে অনুযায়ী উৎপাদন কমেছে কিনা?
পোল্ট্রি শিল্পের প্রসারতা ও সামাজিক গুরুত্বের বিষয় বিবেচনা করে পোল্ট্রি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড গঠন জরুরি বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।