নিজস্ব প্রতিবেদক
নরসিংদীসহ সারা দেশেই টানা কয়েক দিনের বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে বিভিন্ন ফসলি জমি। সবজি চাষাবাদে প্রসিদ্ধ নরসিংদী জেলায়ও এর ব্যাতয় ঘটেনি। গত তিনদিনের টানা বৃষ্টিতে জেলার শিবপুর, রায়পুরা ও বেলাব উপজেলার ফসলি জমিতে বেগুন, মরিচ, কাকরল, পটল, চিচিংগা, শশা, ঢেড়শ, লাউ, মিষ্টি কুমড়া ঝিংগা ও বরবটিসহ বিভিন্ন সবজি ক্ষেত বর্তমানে পানিতে থৈ থৈ করছে। ফলে সবজি গাছগুলোর গোড়া পচে মরে যাবার উপক্রম হয়েছে। ফলে ক্ষেতগুলো থেকে সবজি তোলা অনেকটা বন্ধ হয়ে গেছে। আর এর প্রভাব পড়েছে জেলার সবজির বিভিন্ন পাইকারী ও খুচরা বাজারগুলেতে। ফলে বাড়তি দামে বিক্রি প্রায় সকল সবজি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় এ বছর শীতকালীন সবজি ১০ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ২ লাখ ৪৫ হাজার ৩৬৬ মেট্রিক টন। এপর্যন্ত শীতকালীন সবজির আগাম চাষাবাদ হয়েছে এক হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে। এছাড়াও কৃষক পর্যায়ে ২০ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি করা আছে যা থেকে ১২ হাজার হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষাবাদ করা সম্ভব হবে বলে জানায় জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। পাশাপাশি জানায় এ পর্যন্ত জেলা টানা বৃষ্টিতে মাত্র ৫ হেক্টর জমির শীতকালীন সবজি নষ্ট হয়েছে।
এদিকে গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে নরসিংদীর শিবপুর, রায়পুরা ও বেলাবতে শীতকালীন আগাম সবজি চাষ করা কৃষকের ব্যাপক ক্ষতির আশংকায় রয়েছে বলে জানা গেছে। অনেক জমিতে পানি উঠায় সবজি গাছ নষ্ট হয়েছে। মাঠের পর মাঠ সবজির ক্ষেত এখন পানির নিচে। গত মঙ্গলবার থেকে শনিবার রাত পর্যন্ত টানা বৃষ্টিতে এ অবস্থা হয়েছে বলে জানা যায়।
জেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে অন্তত কৃষকদের খোঁজ নিয়ে ও তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সবজি আবাদ হয়েছে এমন, অনেক মাঠ পুরোটাই বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। আগাম আবাদ করা সবজির ক্ষেত পানির নিচে থাকায় উৎপাদনে ধস নামার আশঙ্কায় রয়েছেন কৃষকেরা।
রায়পুরা উপজেলার বাশঁগাড়ী মধ্যপাড়া গ্রামের হারিছুল হক বলেন, ৮ বিঘা জমিতে মরিচ, বেগুন, শসাসহ বিভিন্ন প্রকার সবজি আবাদ করছিলাম। আর এই সবজি চাষাবাদে আমার প্রায় ২ লাখ টাকা খরচ হয়। সবকিছু ঠিক থাকলে ১০ লাখ টাকা বিক্রি করতে পারতাম। টানা বৃষ্টিতে সব নষ্ট হইয়া গেছে।উত্তর বাখরনগর ইউনিয়নের লোচনপুরা গ্রামে দানিছ মিয়া বলেন, আমি তিন বিঘা জমিতে বেগুন চাষ করি। আর এই তিনবিঘা জমি চাষ করতে আমার খরচ হয় ৬৫ হাজার টাকা। তিনদিদিনের টানা বৃষ্টির পানিতে সব গাছের গোড়ায় পচন ধরে নষ্ট হয়ে গেছে ।
শিবপুর উপজেলার নয়াচর গ্রামের মজিবর রহমান বলেন, প্রতি বছর শীতকালীন সবজি চাষ করে থাকি। গত বছর তিন বিঘা জমিতে শীতকালীন সবজি চাষ করে খরচ বাদে লাভ হয়ে ছিল ৪ লাখ টাকা। এবারও লাভের আশায় ফুলকপি, বাধাকপি টমেটোসহ শীতকালীন সবজি চাষের জন্য প্রায় ৩ বিঘা জমি প্রস্তুত করেছি। কিন্তু বৃষ্টির কারণে সবকিছু ব্যাস্তে গেছে। বৃষ্টির পানিতে সেই জমি বীজ বপনের অনুপযোগি হয়ে পড়েছে।
জানা যায়, সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে অক্টোবরে প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই কমবেশী বৃষ্টিপাত হয়েছে। তাই বেশ কিছু দিন ধরে বাড়তি দামে বিক্রি হওয়া সবজির দাম আরেক দফা বেড়েছে। বাজারে বেশির ভাগ সবজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, যা গত সপ্তাহের চেয়ে ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেশি। সবজির সাথে নতুন করে দাম বাড়ার দৌড়ে রয়েছে কাঁচামরিচ। খুচরা বাজারগুলোতে প্রতি কেজি কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ থেকে ৪০০ টাকায়। আর শতক ছাড়িয়ে বেগুনের দাম। প্রতি কেজি বেগুন বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। প্রায় প্রতিটি সবজি দাম এক লাফে দ্বিগুন বা তারও বেশী দামে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিটি সবজির এই ঊর্ধ্বগতির ফলে সীমিত আয়ের মানুষের জন্য দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে কয়েক দিনের টানা বৃষ্টির প্রভাবে নরসিংদীর সবজিক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে বাজারে কমেছে সবজির সরবরাহ বেড়েছে দাম। এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি শাক-সবজিতে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ দাম বেড়েছে। কোনো কোনো সবজির ক্ষেত্রে দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। দাম বেড়ে যাওয়ায় হিমশিম খাচ্ছেন ক্রেতারা।
আর সবজির দাম বাড়ার কারণ হিসেবে কয়েক দিন ধরে চলা বৃষ্টিপাতকে দায়ী করছেন বিক্রেতারা। তারা বলছেন, যেসব এলাকায় সবচেয়ে বেশি সবজি উৎপাদন হয় সেই এলাকাগুলোতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এতে নরসিংদীসহ ঢাকার পাইকারি বাজারে সবজির আমদানি কম হচ্ছে। ফলে পাইকারি বাজারেই সবজির দাম বেড়েছে।
জেলার বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি টমেটো বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়, গাঁজর প্রতি কেজি ১০০ টাকা, করলা প্রতি কেজি ১২০ টাকা, পটল প্রতি কেজি ৬০ টাকা, শসা প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা, বরবটি প্রতি কেজি ১২০ টাকা, ঝিঙ্গা প্রতি কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা, ধুন্দুল প্রতি কেজি ৬০ টাকা, কচুর লতি প্রতি কেজি ৮০ টাকা, বেগুন (লম্বা) প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা, গোল বেগুন প্রতি কেজি ১২০ থেকে ১৩০ টাকা, পেঁপে প্রতি কেজি ৫০ টাকা, ঢেঁড়স প্রতি কেজি ৮০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া প্রতি পিচ ৪০ টাকা, কাঁচামরিচ প্রতি কেজি ৩৬০ থেকে ৪০০০ টাকা, কচুর মুখি প্রতি কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা এবং কাঁকরোল প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে অস্থিরতা চলছে আলুর বাজারে। এ নিত্যপণ্যটি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা দরে। গত সপ্তাহে আলুর কেজি ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে দাম প্রায় আরও ৫ টাকা বেড়েছে। আলুর এ দাম সাধারণত ক্রেতার জন্য একেবারেই অস্বাভাবিক। গত বছরের এ সময়ে আলুর কেজি ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। সে হিসাবে বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ বেড়েছে আলুর দাম। চড়া দামে থাকা ডিমের বাজারও অপরিবর্তিত রয়েছে।
ক্রেতাদের অভিযোগ, বাজারে সব ধরনের সবজির দামই আকাশ ছোঁয়া। বরবটি, করলা বেগুনসহ বেশ কয়েকটি সবজির দাম ১২০ টাকা হয়েছে। ১০০ টাকার ঘরে আছে শসা, কাঁকরোল। কাঁচামরিচের কেজি দাঁড়িয়েছে ৩৬০ থেকে ৪০০ টাকা। যখন যেভাবে ইচ্ছা ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে, সেখানে ক্রেতাদের কিছুই বলার নেই, কিছুই করার নেই।
নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আজিজুল রহমান জানান, টানা বৃষ্টিতে শীতের আগাম সবজি চাষ খুব একটা ব্যাহত হয়নি। তবে এ বৃষ্টিপাতের ফলে শীতকালীন সবজি চাষ ১৫/২০ দিন পিছিয়ে যেতে পারে। কৃষক পর্যায়ে তারা তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে উপ-সহকারী কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন। অতি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে জেলার যেসকল আমন চাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ইতোমধ্যে ৩ হাজার কৃষককে পূণর্বাসনে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
শিপ্র/শাহোরা/