চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
পতেঙ্গা-কালুরঘাট সড়ককে চট্টগ্রামের লাইফলাইন বলা হয়। চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (সিইপিজেড), বিমানবন্দর, পোর্ট, একাধিক কনটেইনার ডিপোর পাশাপাশি পোশাক খাত-সংশ্লিষ্ট প্রায় সব কর্মকাণ্ড এই সড়ককে ঘিরে হয়ে থাকে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের ব্যাংকপাড়া হিসেবে পরিচিত আগ্রাবাদের বাদামতলীতে এই পথ ব্যবহার করে যেতে হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পোশাক খাতের শ্রমিকরা দাবি আদায়ের জন্য এই পথকে বেছে নিয়েছেন। বকেয়া বেতন পরিশোধ, চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহালের দাবির মতো ইস্যুতে শ্রমিকরা এই সড়কে বসে পড়ছেন। এতে রপ্তানিপণ্য সরবরাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড থমকে যাচ্ছে। এ ছাড়া বিমানবন্দরে আসা-যাওয়া ও ব্যক্তিগত-দাপ্তরিক কাজে কোথাও যেতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রমিকরা চাইলে সিইপিজেডের ভেতরে তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা-বিক্ষোভ করতে পারেন। কিন্তু তারা সেটা না করে মূল সড়কে উঠে আসছেন। এতে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জানা গেছে, ২২ মার্চ বেলা ১১টার দিকে সিইপিজেডের জেএমএস গার্মেন্টের শ্রমিকরা পতেঙ্গা-কালুরঘাট সড়কে বিক্ষোভ শুরু করেন। ফেব্রুয়ারি মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে তারা এ সময় সড়ক অবরোধ করেন। এতে বিমানবন্দরমুখী সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। পরদিন অন্য আরেকটি কারখানার শ্রমিকরা একই কায়দায় নিজেদের দাবি নিয়ে ইপিজেড গেটের সামনে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। এ ছাড়া এক দিন বিরতি দিয়ে ২৪ মার্চ সকাল থেকে জেএমএস গার্মেন্টের শ্রমিকরা আবারও রাস্তায় নামেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নানা জটিলতার কারণে জেএমএস গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ আগেই লে-অফ ঘোষণা করে। লে-অফ চলাকালে শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তাদেরকে বিধি অনুযায়ী ২০ মার্চের মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন পরিশোধের কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা বেতন পরিশোধ না করায় ২২ মার্চ শ্রমিকরা সড়কে আন্দোলনে নামেন। এতে পতেঙ্গা-কালুরঘাট সড়কের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
গত ৫ এপ্রিল সিইপিজেডের ‘এক্সেল শিওর’ নামে একটি কারখানার ৪০ শ্রমিকের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে শ্রমিকরা সকাল থেকে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের সামনে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে দুপুর ২টার দিকে তারা ইপিজেড মোড়ে গিয়ে সড়কে অবস্থান নেন। পরদিন ৬ এপ্রিল সকালে জে-ডব্লিউ অ্যাপারেলসের শ্রমিকরা একই জায়গায় আবারও সড়ক অবরোধ করেন। যদিও শিল্প পুলিশ, ইপিজেড কর্তৃপক্ষ তাদের বুঝিয়ে সেখান থেকে সড়িয়ে দেন।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বলেন, ‘সিইপিজেডে সড়ক অবরোধের কারণে কনটেইনার জাহাজে তুলতে পারিনি। এটাকে আমাদের ভাষায় সার্টআউট বলা হয়। যত বারই সড়ক অবরোধ হয়েছে, তত বারই সার্টআউট হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিদেশি ক্রেতারা আর বাংলাদেশ থেকে পণ্য নিতে চান না।’
ট্রাফিক পুলিশ জানিয়েছে, শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করলে কালুরঘাট-পতেঙ্গা সড়কের দুদিকেই তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে আগ্রাবাদ থেকে ছেড়ে আসা গাড়ি পতেঙ্গার দিকে যেতে পারে না। অন্যদিকে পতেঙ্গা থেকে আসা যানবাহনগুলো স্টিলমিল এলাকায় আটকা পড়ে। এতে এই পথে চলাচলকারীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন। আমদানি-রপ্তানির কনটেইনারবাহী গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে দাঁড়িয়ে থাকে। পণ্য চালানের গাড়ি সিইপিজেডে ঢুকতে বা বের হতে পারে না।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের বন্দর জোনের সহকারী কমিশনার মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘কিছু হলেই শ্রমিকরা রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ের এমন ঘটনা আগে কখনো দেখিনি। কোনো দাবি থাকলে তারা ইপিজেড পরিচালককে জানাতে পারেন। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করতে পারেন। এভাবে সড়কে নেমে রাস্তা বন্ধের মাধ্যমে অন্য নাগরিকের জীবনযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা মোটেই কাম্য নয়।’
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, ‘৫ আগস্টের আগে সিইপিজেডের শ্রমিকদের কখনো সড়ক অবরোধ করতে দেখিনি। ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের তুলনায় চট্টগ্রামের শিল্প কারখানার পরিবেশ অনেক শান্ত। কিন্তু কোনো পক্ষ এটিকে গরম করতে চাইছে। মনে হচ্ছে দেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতেই এ শ্রমিক অসন্তোষ।’
সিইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আব্দুস সোবহান বলেন, ‘প্রতিবারই আমরা মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। সমাধান করে দিয়েছি। কিন্তু আমাদের মনে হচ্ছে শ্রমিকদের অন্য কেউ ব্যবহার করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চাইছে। ইপিজেড শ্রমিকদের বেতন-ভাতা কোনো মালিক পক্ষ আত্মসাৎ করতে পারে না। ইপিজেড কর্তৃপক্ষ কারখানা বিক্রি করে হলেও শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করবে। কিন্তু এরপরও শ্রমিকরা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে সড়কে চলে যাচ্ছেন। এটা মোটেও কাম্য নয়। বিষয়টি আগামীতে কঠোরভাবে দেখা হবে।’
শিপ্র/শাহোরা/লিস/