শিরোনাম :
ক্ষমতায় এলে গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের দায়িত্ব নেবে বিএনপি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ট্রাক ঢুকে পড়ল বাজারে; চাপা পড়ে নিহত ২; আহত ১০ বিচ্ছেদের চিন্তা উড়িয়ে সিঁথি ভর্তি সিঁদুরে কান উৎসবে ঐশ্বরিয়া টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে শেরপুরে বন্যার আশঙ্কা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে নারী কোটা বাতিল পদ্মায় বালুমহাল দখল কেন্দ্র করে দু’পক্ষের সংঘর্ষ; ৭ জন গুলিবিদ্ধ রায়পুরা প্রেসক্লাবের বাষির্ক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত মাসের ব্যবধানে ভোলপাল্ট আ.লীগ থেকে বিএনপিতে সাংবাদিককে জেলে ভরার হুমকি দিলেন ইউএনও বিইউবিটিতে জাতীয় পর্ব এআই অলিম্পিয়াড ২০২৫ সম্পন্ন
শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫, ০৮:৩০ অপরাহ্ন

উত্তরাঞ্চলে হিমাগার সঙ্কটে আলু নিয়ে বিপাকে কৃষকেরা

Reporter Name / ৩৮ Time View
Update : বুধবার, ১৯ মার্চ, ২০২৫

শিরোনাম প্রতিদিন ডেস্ক 

“ফলন ভালো হওয়ায় আমাদের খুশি হওয়ার কথা ছিল, অথচ তার বদলে এখন আহাজারি করতে হচ্ছে। আলু চাষ করে এমন লসের মুখে পড়ছি,” আক্ষেপ করে শিরোনাম প্রতিদিনকে বলছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের আলু চাষী আহসানুর রহমান হাবিব।

বর্গা ও নিজের জমি মিলিয়ে মি. হাবিব এবছর প্রায় ৯০ বিঘা আলু চাষ করেছেন। আলু চাষে প্রতিকেজিতে খরচ হয়েছে অন্তত বিশ টাকা বলে দাবি করেছেন তিনি। কিন্তু ফসল তোলার পর সেই আলু এখন বিক্রি করচ্ছে গড়ে ১৩ টাকা দরে। “বীজ, সার, লেবার কস্টিং মিলায়ে বিঘাপ্রতি আমার খরচ পড়েছে লাখের ওপরে। আর এখন আলু বিক্রি করে পাচ্ছি গড়ে ৬৫ হাজার। বিঘায় ৩৫ হাজার টাকা লস,” বলেন মি. হাবিব।

হিমাগার সঙ্কটে আলু নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন দেশের উত্তরাঞ্চলের  আলু চাষিরা। রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম,  দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাটে প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রতুল হওয়ায় বিপাকে পড়েছে আলু চাষীরা। উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে অনেক কমে বিক্রি করতে হচ্ছে। ফলে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়ে তারা।

উত্তরাঞ্চলে চাহিদার কয়েক গুণ বেশি আলু উৎপাদিত হয়। খাবারের চাহিদা ও খেত থেকে বিক্রি শেষে উদ্বৃত্ত থাকে অনেক আলু। তবে তা সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় মৌসুমের শুরুতে বিক্রি করতে বাধ্য হন কৃষক। যাঁরা সংরক্ষণ করেন, তাদের ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে আলুর দামে। মৌসুমের শুরুতে যে আলু ১০ টাকা, বছরের শেষ দিকে তা বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, একশ্রেণির ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণ করছেন। আর ব্যবসায়ী ও হিমাগারমালিকদের দাবি, সংরক্ষণ ব্যয় বাড়ায় দামের ওপর তার প্রভাব ফেলছে।

কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এবারে রংপুর কৃষি অঞ্চলে আলুর আবাদ হয়েছে ৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭ হেক্টর জমিতে। আলু উৎপাদিত হয়েছে ২৬ লাখ ৮৪ হাজার টন। হেক্টরে গড় উৎপাদন ২৭ টনের বেশি। রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাটে এসব আলু সংরক্ষণের জন্য হিমাগার আছে ৭০টি। যেখানে আলু সংরক্ষণ করা যায় মাত্র ৬ লাখ ৬০ হাজার টন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, রংপুরে এবার যে পরিমাণ আলুর আবাদ হয়েছে, তাতে সারা বছরের খাবারের চাহিদা, বীজ আর বিক্রি করা আলু বাদ দিয়ে ১৬ লাখ ১২ হাজার টন আলু উদ্বৃত্ত থাকে।

রংপুরের তারাগঞ্জের বড় আলুচাষি জিয়া রহমান। এবার তিনি ১০ একর জমিতে কার্ডিনাল ও স্টারিক্স জাতের আলু চাষ করেছিলেন। মৌসুমের শুরুতে ৫ একর জমির আলু ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন। আর ৫ একর জমির আলু এনএন ও সিনহা হিমাগারে সংরক্ষণ করেছিলেন। জিয়া রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘হিমাগারে রাখা আলু সর্বশেষ ২৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি। হিমাগার ভাড়া, বস্তা, উৎপাদন খরচসহ আমার ২৩ টাকা পড়েছে। অন্যবারের তুলনায় হিমাগার ভাড়া বেশি হওয়ায় এবার লাভ কম। তারপরও সব আলু হিমাগারে রাখতে পারলে ভালো লাভ হতো। কিন্তু হিমাগারে তো জায়গা নাই।’

বামনদীঘি গ্রামের আলুচাষি রিপন মিয়া বলেন, ‘আগে ৯০ কেজির বস্তা হিমাগারে রাখতে খরচ পড়ত ২৫০ টাকা। এখন ৫০ কেজির আলুর বস্তা হিমাগারে রাখতে ৩০০ টাকা। ৫০ টাকার খালি বস্তা এখন ৮০ টাকা, ক্যারিং খরচ, লেবার খরচ দ্বিগুণ। ওই জন্য জমিতেই আলু বিক্রি করি। এবারে ১০ টাকা যে আলু খেত থেকে তুলে বিক্রি করেছি, সেই আলু ৫০ টাকায় কিনে খাচ্ছি।’

প্রতিবছর মাঠপর্যায়ে আলু কিনে হিমাগারে সংরক্ষণ করেন তারাগঞ্জের মিলন মিয়া। তিনি বলেন, ‘মূলত আলুর সংরক্ষণ খরচ বাড়ায় এবার আলুর দাম বেড়েছে। তা ছাড়া, উৎপাদন খরচ বাড়ায় এবার মাঠেও চাষিদের কাছ থেকে আলু বেশি দামে কিনতে হয়েছে।’

হিমাগার সঙ্কটে আলু নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন দেশের উত্তরাঞ্চলের  আলু চাষিরা। জেলার দক্ষিণ-পূর্বাংশের ফুলবাড়ী, বিরামপুর, নবাবগঞ্জ, হাকিমপুর ও ঘোড়াঘাট এই পাঁচ উপজেলা মিলিয়ে একটিমাত্র হিমাগার রয়েছে। সেটিও ফুলবাড়ীতে। ফলে সংরক্ষণের জায়গার অভাবে চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে এ অঞ্চলের কৃষক-ব্যবসায়ীদের।

মৌসুমের শুরু থেকে হিমাগারের সামনে আলু বোঝাই গাড়ির দীর্ঘ সারি। হিমাগারের ভেতরে শতাধিক ট্রাক্টর, ভটভটি ও ব্যাটারিচালিত ভ্যানে ভর্তি আলু নিয়ে হিমাগারে ঢোকানোর অপেক্ষায় কৃষকেরা। হিমাগারের ভেতরের অংশের পাশাপাশি ঢোকার অপেক্ষায় বাইরেও অবস্থান করছে শতাধিক ট্রাক্টর ভর্তি আলু।

হাকিমপুর উপজেলার খট্রা-মাধবপাড়া গ্রামের আলু চাষি নাজমুল হক বলেন, “চলতি মৌসুমে আগাম জাতের দুই বিঘা আলু চাষ করেছিলাম। প্রথমে দাম অনেক ভাল পেয়েছি। পরে চার বিঘা জমিতে আলুর আবাদ করি। হিমাগারে রাখার জন্য এক ট্রাক্টর আলু নিয়ে ফুলবাড়ী উপজেলার রাঙামাটির ফুলবাড়ী কোল্ডস্টোরেজে নিয়ে এসেছি। এখনও সিরিয়ালের কোনো স্লিপ পাইনি। আদৌ আলু হিমাগারে রাখতে পারবেন কি না, তা জানি না।”

জায়গা না পেলে হয়তো ফিরে যেতে হবে এই কৃষককে। এতে একদিকে সময়ের অপচয়, অন্যদিকে গুনতে হচ্ছে বাড়তি গাড়িভাড়া। একে তো আলুর দাম কম, আবার সংরক্ষণের জায়গার অভাবে চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে এ অঞ্চলের কৃষক-ব্যবসায়ীদের।

উপজেলার মোমিনুল, এরশাদ সরকার, জাকিরুল ইসলাম, কবির হোসেনসহ বেশ কয়েকজন আলু চাষি একই অভিযোগ করে বলেন, “এমন ভোগান্তিতে পড়তে হবে আগে জানতাম না। এত কষ্ট করে আলু চাষ করে তা সংরক্ষণ করতে পারছি না।”

নবাবগঞ্জ উপজেলার আফতাবগঞ্জ গ্রামের আলু চাষি কৃষক রজব আলী বলেন, “আগামী বছরে আলু চাষের জন্য বীজের জন্য ৬০ কেজির তিন বস্তা আলু নিয়ে এসেছি হিমাগারে। সিরিয়াল এখনও পাইনি, জানি না পাব কি না।”

ফুলবাড়ী উপজেলার পাকাপান গ্রামের আলু চাষি লিয়াকত আলী বলেন, “৫৫ কেজির ২৫ বস্তা আলু বীজ হিসেবে সংরক্ষণের জন্য এখানে এনেছি। হিমাগারের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে রাখার জায়গা পাব না। কৃষক আর ব্যবসায়ীদের যত আলুর গাড়ি ঠাসাঠাসি অবস্থায় আছে। তা দেখে মনে হচ্ছে আলু নিয়ে ফিরে যেতে হবে।”

ফুলবাড়ী কোল্ডস্টোরেজের ব্যবস্থাপক মাহমুদুল হাসান বলেন, “কৃষকদের অগ্রাধিকার দিয়েই আলু সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোল্ডস্টোরেজের ধারণক্ষমতা ৬০ কেজির ১ লাখ ৬০ হাজার বস্তা। এরই মধ্যে আলু সংগ্রহ ধারণ ক্ষমতা পূরণ হয়ে গেছে। তবুও কৃষকদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে হিমাগারের প্রাথমিক শীতলীকরণ (অতিরিক্ত) জায়গায় কিছু বস্তা রাখার চেষ্টা করছি। এরপরেও হাজার হাজার বস্তা আলু নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছেন অনেকে। জায়গার অভাবে উপায় না পেয়ে কৃষকদের ফেরত দিতে হচ্ছে।”

ফুলবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রুম্মান আক্তার বলেন, “গত বছর এই উপজেলায় আলুর আবাদ হয়েছিল ১ হাজার ৭৭০ হেক্টর এবং এ বছর আবাদ হয়েছে ১ হাজার ৮৭০ হেক্টর জমিতে। ৪৫ হাজার ৮১৫ টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকাসহ প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না আসায় আলুর আবাদ ও ফলন ভাল হয়েছে।”

দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) মো. আনিছুজ্জামান বলেন, “আলুর দাম কমে যাওয়ায় কৃষকদের পাশাপাশি আলু সংরক্ষণের দিকে ঝুঁকেছেন ব্যবসায়ীরাও। এতে প্রতিটি হিমাগারের ওপর চাপ বেড়েছে। আলু সংরক্ষণের সক্ষমতা বাড়ানো গেলে আলুর আমদানি নির্ভরতা কমে আসবে, এতে কৃষকেরা লাভবান হবেন।”

রংপুর হিমাগার মালিক সমিতির সভাপতি ব্যবসায়ী মোসাদ্দেক হোসেন বাবলু বলেন, অন্য বছরগুলোতে এ সময়ে হিমাগারগুলো থেকে ২০ থেকে ২৫ হাজার বস্তা আলু বের হতো। কিন্তু এবার ৭০ থেকে ৮০ হাজার বস্তা আলু বের হয়ে গেছে। যে হারে আলুর চাহিদা দেখা যাচ্ছে, তাতে অক্টোবরের পর আলুর আরও সংকট দেখা দিতে পারে। এতে আরও দাম বাড়বে।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, রংপুরে উৎপাদনের তুলনায় হিমাগার অপ্রতুল। হিমাগারের সংখ্যা যত বেশি বাড়বে, আলু উৎপাদন ও সংরক্ষণ তত বাড়বে। পর্যাপ্ত সংরক্ষণাগারের অভাবে আলুর একটি বড় অংশ নষ্ট হয়, এ কারণে বছর শেষে আলুর দাম বেড়ে যায়।

এ কর্মকর্তা আরও জানান, আলুর সংরক্ষণ ব্যবস্থা বাড়াতে পদক্ষেপ নিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। গৃহপর্যায়ে আলু সংরক্ষণে অহিমায়িত মডেল ঘর নির্মাণ করে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করছে প্রতিষ্ঠানটি। এই প্রকল্পটির কাজ শেষে হলে আলু সংরক্ষণের পরিমাণ বাড়ানো যাবে, ফলে দামও কমে আসবে।

শিপ্র/শাহোরা/


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!